যাকাত কি ও যাদের উপর যাকাত ফরজ |
যাকাতের বিষয়ে কঠোর হুশিয়ারি
হযরত আবুজর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে এলাম। তিনি সে সময় কা’বার ছায়াতে বসে ছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি আমাকে সম্মুখে আসতে দেখে বলেনঃ কা’বার প্রভুর শপথ! তারা কিয়ামাতের দিবসে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় হাযির হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি মনে মনে বললাম, আমার কি হল, মনে হয় আমার প্রসঙ্গে তার উপর কোন কিছু নাযিল হয়েছে। আমি বললাম, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা নিবেদিত হোক! এধরণের লোক কারা? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ অধিক ধনদৌলত আত্মসাৎকারী, কিন্তু যে সব লোক এই, এই ও এই পরিমাণ দিয়েছে সে সব লোক ছাড়া। তিনি সামনে, ডানে ও বামে হাতের ইশারা করলেন। তারপর তিনি বললেনঃ সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন! যে লোক এধরণের উট অথবা গরু রেখে মৃত্যুবরণ করল যার যাকাত সে দেয়নি, কিয়ামাতের দিন সেগুলো পূর্বাবস্থা হতে বেশি মোটাতাজা হয়ে তার নিকটে আসবে এবং নিজেদের পায়ের ক্ষুর দ্বারা তাকে দলিত করবে এবং শিং দ্বারা গুঁতো মারবে। সবশেষের জন্তুটি চলে যাওয়ার পর আবার প্রথম জন্তুটি ফিরে আসবে। মানুষের সম্পূর্ণ বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত শাস্তির এ ধারা চলতে থাকবে।সহীহ্, তা’লাকুর রাগীব (১/২৬৭)।
ফুট নোট
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতেও একই রকম হাদীস বর্ণিত আছে। আলী (রাঃ) বলেন, যাকাত অমান্যকারীকে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কাবীসা ইবনু হুলব তার পিতা থেকে, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতেও হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, আবূ যারের হাদীসটি হাসান সহীহ। আবূ যার (রাঃ)-এর নাম জুনদাব ইবনুস সাকান, কারো মতে ইবনু জুনাদা। দাহ্হাক ইবনু মুযাহিম বলেন, যার দশ হাজার (দিরহাম) রয়েছে সেই অধিক সম্পদশালী।
যাকাত আদায় করা আবশ্যক
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ যখন তুমি তোমার ধন-সম্পদের যাকাত আদায় করে ফেললে, তুমি তোমার কর্তব্যভার পালন করলে।
যঈফ ইবনু মাজাহ (১৭৮৮)।
আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান গারীব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট হতে একাধিক সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি যাকাত নিয়ে আলোচনা করলে এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এ ব্যতীতও কি আমার কিছু করার আছে? তিনি বলেনঃ না, তবে বাড়তি (দান-খাইরাত) করতে পার। ইবনু হুজাইরার নাম আব্দুর রহমান ইবনু হুজাইরাহ আল-মিসরী।
সোনা রুপার যাকাত কিভাবে দিবো
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ঘোড়া ও গোলামের সাদকা (যাকাত) আমি ক্ষমা করেছি, কিন্তু প্রতি চল্লিশ দিরহাম রূপার ক্ষেত্রে এক দিরহাম সাদকা (যাকাত) আদায় কর। কিন্তু একশত নব্বই দিরহামে কোন সাদকা নেই। যখন তা দুই শত দিরহামে পৌছবে তখন তাতে পাঁচ দিরহাম সাদকা দিতে হবে।
-সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৭৯০)।
আবূ বাকার সিদীক ও আমর ইবনু হাযম (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, আমাশ, আবূ আওয়ানা ও অন্যান্যরা আবূ ইসহাকের সনদের ধারাবাহিকতায় আলী (রাঃ)-এর নিকট হতেও এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুফিয়ান সাওরী, ইবনু উআইনা ও অন্যরাও আবূ ইসহাকের বরাতে আল-হারিসের সূত্রে আলী (রাঃ) হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। উভয় সূত্রকেই ইমাম বুখারী সহীহ বলেছেন। কারণ, হয়ত আসিম ও হারিস দু’জনের নিকট হতে এটি বর্ণিত আছে।
উট ভেড়া ও ছাগলের যাকাত সম্পর্কে ধারণা
সালিম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ও তার পিতা হতে বর্ণিত
সাদকা (যাকাত) প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ফরমান (অধ্যাদেশ) লিখালেন। তার কর্মচারীদের নিকটে এটা পাঠানোর আগেই তিনি মারা যান। তিনি এটা নিজের তরবারির সাথে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর পর আবূ বাকার (রাঃ) তা কার্যকর করেন। তিনিও মারা যান। উমার (রাঃ)-ও সে অনুযায়ী কাজ করেন। তারপর তিনিও মারা যান। তাতে লেখা ছিল পাঁচটি উটের জন্য একটি বকরী, দশটি উটের জন্য দুটি বকরী, পনেরটি উটের জন্য তিনটি বকরী এবং বিশটি উটের জন্য চারটি বকরীর যাকাত আদায় করতে হবে। পঁচিশ হতে পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত উটের জন্য একটি বিনতু মাখায (একটি পূর্ণ এক বছরের মাদী উট); এর বেশি হলে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত (ছত্রিশ হতে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত) উটের জন্য একটি বিনতু লাবুন (একটি পূর্ণ দুই বছরের মাদী উট); এর বেশি হলে ষাট পর্যন্ত (ছিচল্লিশ হতে ষাট পর্যন্ত) উটের জন্য একটি হিক্কাহ (একটি পূর্ণ তিন বছরের মাদী উট);
আবার এর বেশি হলে পঁচাত্তর পর্যন্ত (একষট্টি হতে পঁচাত্তর পর্যন্ত) উটের জন্য একটি জাযাআহ (একটি চার বছরের মাদী উট); আরো বেশি হলে নব্বই পর্যন্ত (ছিয়াত্তর হতে নব্বই পর্যন্ত) উটের জন্য দু’টি বিনতু লাবূন; আরো বেশি হলে একশত বিশ পর্যন্ত (একানব্বই-একশত বিশ) উটের জন্য দু’টি হিক্কাহ এবং যখন একশত বিশের বেশি হবে তখন প্রতি পঞ্চাশ উটের জন্য একটি হিক্কাহ এবং প্রতি চল্লিশ উটের জন্য একটি বিনতু লাবূন যাকাত আদায় করতে হবে।ভেড়া বকরীর যাকাত হলঃ চল্লিশ হতে এক শত বিশ পর্যন্ত বকরীর জন্য একটি বকরী; এর বেশি হলে দু’শত পর্যন্ত দুটি বকরী; এর বেশি হলে তিনশত পর্যন্ত বকরীর জন্য তিনটি বকরী; তিনশতর বেশি হলে প্রতি একশত বকরীর জন্য একটি করে বকরী যাকাত আদায় করতে হবে। তারপর বকরীর পরিমাণ আবার একশত পর্যন্ত না পৌছালে (পুনরায়) কোন যাকাত দিতে হবে না।
যাকাতের ভয়ে (একাধিক মালিকানায়) বিচ্ছিন্নগুলোকে একত্র করা এবং একত্রগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এক সাথে দুই শরীকের পশু থাকলে প্রত্যেকে নিজ নিজ অংশের হিসাব করে সঠিকভাবে যাকাত আদায় করবে। যাকাতে বৃদ্ধ এবং ক্রটিযুক্ত পশু গ্রহণ করা হবে না।
-সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৭৯৮)।
গরুর সম্পদ যাকাতের বিধান
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ত্রিশটি গরুর যাকাত (দিতে হবে) একটি এক বছরের এড়ে বাছুর অথবা বকনা বাছুর। চল্লিশটি গরুর যাকাত (দিতে হবে) একটি দুই বছরের বাছুর।
-সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৮০৪মুআয ইবনু জাবাল (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, আব্দুস সালাম ইবনু হারব খুসাইফ হতে হাদীসটি এভাবেই বর্ণনা করেছেন। আবদুস সালাম নির্ভরযোগ্য এবং স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন একজন বর্ণনাকারী। শারীক এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন খুসাইফ হতে, তিনি আবূ উবাইদাহ হতে, তিনি তার পিতা আব্দুল্লাহ হতে, আবূ উৰাইদ ইবনু আবদুল্লাহ তাঁর পিতার নিকট কোন প্রকার হাদীস শুনেননি।)।
নাৰী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়ামানে (গভর্ণর করে) প্রেরণ করলেন এবং আদেশ দিলেনঃ আমি যেন প্রতি ত্রিশটি গরুর ক্ষেত্রে একটি এক বছরের এড়ে বাছুর অথবা বকনা বাছুর; প্রতি চল্লিশটি গরুর ক্ষেত্রে একটি দুই বছরের বাছুর (যাকাত হিসেবে) এবং প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়সের (জিম্মী) লোকের নিকট হতে এক দীনার (স্বর্ণ মুদ্রা) অথবা একই মূল্যের মাআফির নামক কাপড় (জিয্য়া হিসাবে) আদায় করি।
-সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৮০৩)।
কৃষিজাত ফসল ফল ও শস্য এর যাকাত সম্পর্কে মৌলিক ধারণা
আবু সাদ আল খুদরী রাঃ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ পাঁচের কম সংখ্যক উটে কোন যাকাত আদায় করতে হবে না; পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রূপাতে কোন যাকাত আদায় করতে হবে না এবং পাঁচ ওয়াসাকের কম পরিমাণ ফসলে কোন যাকাত আদায় করতে হবে না।
-সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৭৯৩), বুখারী, মুসলিম
এই হাদীসের ভিত্তিতে আলিমগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, পাঁচ ওয়াসাকের কম পরিমাণ শস্যে কোন যাকাত আদায় করতে হবে না। ষাট সা’ পরিমাণে এক ওয়াসাক হয়। অতএব, পাঁচ ওয়াসাকে তিনশত সা’ হবে। সোয়া পাঁচ রোতলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সা’ হত। কূফাবাসীদের এক সা’ হয় আট রোতল পরিমাণে। পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রূপার ক্ষেত্রে যাকাত ধার্য হয় না। চল্লিশ দিরহাম পরিমাণে এক উকিয়া হয়। অতএব, পাঁচ উকিয়া পরিমাণে দুই শত দিরহাম হয় পাঁচ যাওদ অর্থাৎ পাঁচের কম সংখ্যক উটের ক্ষেত্রে যাকাত ধার্য হয় না। উটের সংখ্যা পঁচিশে পৌছলে তখন যাকাত হিসেবে এক বছরের একটি মাদী উট আদায় করতে হবে। পঁচিশের কম সংখ্যক উট হলে প্রতি পাঁচটি উটে একটি বকরী যাকাত আদায় করতে হবে।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url